চার মাযহাবের সিদ্ধান্তসমূহ কোনো বিষয়ে বিভিন্ন হলে স্রেফ একটি রায়-ই সঠিক


“চার মাযহাবের সিদ্ধান্তসমূহ কোনো বিষয়ে বিভিন্ন হলে স্রেফ একটি রায়-ই সঠিক। যাঁরা সঠিক পদ্ধতিতে সেই আমল/অনুশীলনী পালন করবেন, তাঁরা পাবেন দুটি সওয়াব/পুরস্কার; আর যাঁরা ভুল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমল করবেন, তাঁদেরকে দেয়া হবে একটি সওয়াব। মাযহাবগুলো যে রহমত-স্বরূপ তা পরিদৃষ্ট হয় এই বাস্তবতা দ্বারা যে এক মাযহাব ছেড়ে আরেকটি মাযহাবের অনুসরণ জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত এই চার মাযহাব ছাড়া অন্য মাযহাব অনুসরণের কোনো অনুমতি-ই নেই; এমন কী সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’এর মাযহাবও নয়, যেহেতু তাঁদের মাযহাবগুলো লিপিবদ্ধ আকারে আসেনি এবং এরই ফলশ্রুতিতে বিস্মৃত হয়েছে। জ্ঞাত এই চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোনো মাযহাব অনুসরণের কোনো সম্ভাবনাই নেই।



❏ ইমাম আবূ বকর আহমদ রা’যী (বেসাল: ৩৭০ হিজরী/৯৮০ খৃষ্টাব্দ)-ও বর্ণনা করেছেন যে,



اِجْماَعُ الْمُحَقِّيْقِّنَ عَلَيْ مَنْعِ الْعَوَامِ مِنْ تَقْلِيْدِ اَعْيَانِ الصَحَابَةِ وَاكَابِرُهُمْ نَعَمْ يَجُوْزُ عَامِيِ مِنَ الفُقَهَاءِ تَقْلِيدُ غَيْرَ الاَرْبَعَةِ فِيْ العَمَلِ لِنَفْسِهِ



ইসলামী উলামা-মণ্ডলী সর্বসম্মতভাবে জানিয়েছেন (সরাসরি) সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)’কে অনুসরণ (করার চেষ্টা করা) জায়েয নেই। মাযহাবগুলোর ও মুজতাহিদবৃন্দের শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ করে মাযহাবগুলোর ক্বুরআন-সুন্নাহকে ছাড়িয়ে না যাওয়ার এবং এজমা’ ও ক্বেয়াসের মাধ্যমে বের করা বিধিবিধানগুলো নিজেদের মনগড়া না হয়ে ক্বুরআন-সুন্নাহ হতে নিঃসৃত সিদ্ধান্ত হওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে যাঁরা বুঝতে চান, তাঁদের প্রতি আমি পরামর্শ দেই ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শারানী  (رحمة الله)’র প্রণীত ‘আল-মীযা’ন আল-কুবরা’য়া’ ও ‘আল-মীযা’ন আল-খিদরিয়্যা’ গ্রন্থ দুটো পড়তে। {ইঊসুফ নাবহানী কৃত ‘হুজ্জাত-আল্লাহি ‘আলাল-’আলামীন’, ৭৭১ পৃষ্ঠা; মূল আরবী বই হতে অনূদিত ওপরের উদ্ধৃতিটিতে অনুবাদকের কোনো কথা যুক্ত হয়নি; আমাদের অন্যান্য বইযের মতো অনুবাদকের সংযোজনীগুলো এখানেও ব্র্যাকেটের মধ্যে রাখা হয়েছে, যাতে অনূদিত অংশের ব্যাপারে বিভ্রান্তি দেখা না দেয়। মূল আরবী ‘হুজ্জাত-আল্লাহি আলাল-আলামীন’ বইটি ইস্তাম্বুল হতে অফসেটে পুনর্মুদ্রিত হয় ১৩৯৪ হিজরী/১৯৭৪ সালে}  



এ কথা বলা সঠিক নয় – ‘উলামায়ে দ্বীনের ব্যাপারে ক্বুরআনুল করীমে (সম্বোধনসূচক) কোনো উল্লেখ নেই।’ বহু আয়াতে পাকে ইসলামী উলামা ও এলম/জ্ঞানের প্রশংসা করা হয়েছে। ইমাম আবদুল গনী নাবলুসী (বেসাল: ১১৪৩ হিজরী/১৭৩১ খৃষ্টাব্দ) তাঁর ‘আল-হাদীক্বা’ পুস্তকে লেখেন:



❏ “সূরা আম্বিয়া’র ৭ম আয়াতে এরশাদ হয়েছে –


 فَاسْئَلُوۤاْ أَهْلَ ٱلذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ


‘তোমরা না জানলে জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞেস করে শেখো।’ এ আয়াতোক্ত ‘যিকর’ অর্থ ’জ্ঞান।’ যারা স্বল্প জ্ঞানী তাদেরকে আয়াতটি উলামাদের শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের কাছ থেকে বিদ্যা শিক্ষা করার আদেশ দেয়।’



❏ সূরা আলে ইমরানের সপ্তম আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –



هُوَ ٱلَّذِيۤ أَنزَلَ عَلَيْكَ ٱلْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ في قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ٱبْتِغَاءَ ٱلْفِتْنَةِ وَٱبْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ ٱللَّهُ وَٱلرَّاسِخُونَ فِي ٱلْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلاَّ أُوْلُواْ ٱلأَلْبَابِ



অর্থাৎ, ‘দ্ব্যর্থবোধক আয়াতগুলো কেবল জ্ঞানী (ঈমানদার) ব্যক্তিবর্গ-ই জানে।’



❏ একই সূরার ১৮ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –



شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ وَٱلْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلْعِلْمِ قَآئِمَاً بِٱلْقِسْطِ لاَ إِلَـٰهَ إِلاَّ هُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ



অর্থাৎ, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই আর ফেরেশতাবর্গ ও জ্ঞানীবৃন্দ-ও ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া অন্য কারো এবাদত নেই, (তিনি) মহা মর্যাদাবান, প্রজ্ঞাময়।’



❏ সূরা ক্বাসাসের ৮১ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –



وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ ٱللَّهِ خَيْرٌ لِّمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحاً وَلاَ يُلَقَّاهَآ إِلاَّ ٱلصَّابِرُونَ



অর্থাৎ, ‘এবং বল্লো ওইসব লোক, যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে: তোমাদের ধ্বংস সাধন হোক! আল্লাহর পুরস্কার উত্তম ওই ব্যক্তির জন্যে, যে ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে; আর এটা তারাই পায় যারা ধৈর্যশীল।’



❏ সূরা রূমের ৫৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –



وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ وَٱلإِيمَانَ لَقَدْ لَبِثْتُمْ فِي كِتَابِ ٱللَّهِ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْبَعْثِ فَهَـٰذَا يَوْمُ ٱلْبَعْثِ وَلَـٰكِنَّكُمْ كُنتمْ لاَ تَعْلَمُونَ



অর্থ: ‘এবং বল্লো তারাই, যাদেরকে জ্ঞান ও ঈমান প্রদান করা হয়েছে: নিশ্চয় তোমরা অবস্থান করেছিলে আল্লাহর লিপির মধ্যে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত। সুতরাং এটাই হচ্ছে ওই দিন পুনরুত্থানের; কিন্তু তোমরা জানতে না।’



❏ সূরা ইসরা’র ১০৭/৮ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –



قُلْ آمِنُواْ بِهِ أَوْ لاَ تُؤْمِنُوۤاْ إِنَّ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ مِن قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلأَذْقَانِ سُجَّداً وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَآ إِن كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولاً



অর্থাৎ, ‘(হে রাসূল) আপনি বলুন: তোমরা এর ওপর ঈমান আনো অথবা না আনো! নিশ্চয় ওই সব লোক যারা এটা (ক্বুরআন) অবতীর্ণ হবার আগে জ্ঞান লাভ করেছে, যখনই তা তাদের প্রতি পাঠ করা হয় তারা থুতনির ওপর ভর করে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে; আর বলে, পবিত্রতা আমাদের রব্বের জন্যে; নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবারই ছিলো।’



❏ সূরা হজ্জ্ব ৫৪ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –



وَلِيَعْلَمَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ أَنَّهُ ٱلْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَيُؤْمِنُواْ بِهِ



অর্থাৎ, ‘এবং এ জন্যে যে জানতে পারে ওই সব লোকও, যারা জ্ঞান লাভ করেছে যে তা (মানে ক্বুরআন) আপনার রব্বের কাছ থেকে সত্য; অতঃপর তারা যেনো সেটার প্রতি ঈমান আনে।’



❏ সূরা আনকাবূতের ৪৯ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –



بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ



অর্থ: ‘বরং ওটা (মানে ক্বুরআন) সুস্পষ্ট নিদর্শন তাদের অন্তরের মধ্যে, যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে।’



❏ সূরা সাবা’র ৫৯ আয়াতে বলা হয়েছে –



وَيَرَى ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ ٱلَّذِيۤ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ هُوَ ٱلْحَقَّ وَيَهْدِيۤ إِلَىٰ صِرَاطِ ٱلْعَزِيزِ ٱلْحَمِيدِ



অর্থাৎ, ‘এবং যারা জ্ঞান লাভ করেছে তারা জানে যে, যা কিছু আপনার প্রতি আপনার রব্বের কাছ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে (ক্বুরআন), তা-ই সত্য এবং সম্মানের অধিকারী, সমস্ত প্রশংসায় প্রশংসিতের পথনির্দেশ করে।’ ‍



❏ সূরা মুজাদা’লার ১১ আয়াতে এরশাদ হয়েছে –



وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْعِلْمَ دَرَجَاتٍ



অর্থ: ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা (আখেরাতে) সমুন্নত করবেন।’



❏ সূরা ফাতিরের ২৮ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে –



إِنَّمَا يَخْشَى ٱللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ ٱلْعُلَمَاءُ



অর্থাৎ, ‘আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে তারাই ভয় পায়, যারা জ্ঞানসম্পন্ন।’



❏ সূরা হুজুরাতের ১৪ আয়াতে বলা হয়েছে –



إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عَندَ ٱللَّهِ أَتْقَاكُمْ



অর্থ: ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে অধিক সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে অধিক খোদাভীরু।’



❏ একই গ্রন্থের (আল-হাদীক্বা) ৩৬৫ পষ্ঠায় উদ্ধৃত হাদীসগুলোতে এরশাদ হয়েছে:



إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرَضِينَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ



‘আল্লাহতায়া'লা, ফেরেশতাকুল ও সকল সৃষ্টি সেই ব্যক্তির ভালাই কামনা করেন, যে মানুষকে উত্তম বিষয়াদি শিক্ষা দেয়’



🔺(ক/ তিরমিযী: আস্ সুনান, ৯:২৯৯, হাদীস নং ২৬০৯; খ/ আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ১:৪৬, হাদীস নং ২১৩; গ/ আব্দুর রাযযাক: আল-মুসান্নাফ, ১১:৪৬৯; ঘ/ তাবারানী: আল-মু‘জামুল কাবীর, ৭:২৬৭);



يَشْفَعُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثَلَاثَةٌ الْأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الْعُلَمَاءُ ثُمَّ الشُّهَدَاءُ



❏ ‘শেষ বিচার দিবসে প্রথমে আম্বিয়া (عليه السلام), তারপর উলামা (-এ-হক্কানী/রব্বানী) এবং তারপর শহীদান সুপারিশ করবেন’



🔺(ক/ ইবনে মাজাহ: আস সুনান, ১২:৩৭২, হাদীস নং ৪৩০৪; খ/ আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩:২১৯; গ/ বায়হাকী: শু‘য়াবুল ইমান, ৪:২৩১, হাদীস নং ১৬৬৮);



يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ



❏ ‘ওহে মানব সকল! জেনে রেখো, জ্ঞান (একমাত্র উলামাবৃন্দের) তা’লিম/পাঠদান বা প্রশিক্ষণ দ্বারা শেখা যায়।’ 🔺(তাবারানী: আল-মু‘জামুল কাবীর, ১৪:৩২৪);



تَعَلِّموُا العِلْمَ فَاِنَّ تَعَلَّمَهُ لِلهِ خَشِيَةٌ وطلبه عِبَادَةٌ وَمُذَاكَرَاتَهُ تَسْبِيْحٌ وَالْبَحْثُ عَنْهُ جِهَادٌ وَتَعْلِيْمُهُ لِمَنْ لاِ يَعْلِمُهُ صَدْقَةٌ وَبْذْلُهُ لِاَهْلِهِ قُربَةٌ



❏ ‘জ্ঞান শিক্ষা করো! (কেননা) তা একটি এবাদত। (দ্বীনী জ্ঞান) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে জ্বেহাদ করার সওয়াব/পুরস্কার দেয়া হবে। জ্ঞান শিক্ষাদান দান-সদকাহ’র মতোই। আলেমের কাছ থেকে জ্ঞান শিক্ষা করা মধ্য রাতের নামায আদায়ের মতো সওয়াবদায়ক।’



তা‘হির নাজা’রী (ইন্তেক্বাল: ৫৪২ হিজরী/১১৪৭ খৃষ্টাব্দ) যিনি ‘খুলা’সা’ নামের ফতোয়াগ্রন্থের প্রণেতা, তিনি বিবৃত করেন: ‘ফেক্বাহর বইপত্র পাঠ করা রাতে নামায আদায়ের চেয়েও সওয়াবদায়ক। কেননা ফরয/বাধ্যতামূলক আমল ও হারাম/নিষিদ্ধকর্মগুলো সম্পর্কে উলামাবৃন্দ (বা তাঁদের বইপত্র) হতে জানাটা ফরয। জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ তথা অনুশীলনের জন্যে বা তা শিক্ষা দেয়ার খাতিরে ফেক্বাহ’র বইপুস্তক পাঠ করা সালাতু্স্ তাসবীহ (নামায) আদায়ের চেয়েও শ্রেয়তর। একটি হাদীস শরীফে এসেছে – ‘জ্ঞানার্জন করা নফল এবাদত-বন্দেগীর চেয়েও বেশি সওয়াবদায়ক; কেননা তা যেমন কারো জন্যে উপকারী, তেমনি অন্য যাদেরকে সে তা শিক্ষা দেয়, তাদের জন্যেও তা উপকারী’;



مَنْ تَعَلَّمَ بَابَا مِنَ الْعِلمِ لِيَعْلَمَ النَّاسَ أُعْطِيَ ثَوَابُ سَبعِيْنَ صِدِّيقًا



❏ ‘যে ব্যক্তি অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে জ্ঞানার্জন করে, তাকে সিদ্দীক্ব তথা সত্যনিষ্ঠ বুযূর্গদের মতো সওয়াব দেয়া হবে (আল-হাদীস)।’



ইসলামী বিদ্যা শিক্ষা স্রেফ কোনো শিক্ষক/মুর্শীদ ও বইপত্র থেকে আহরণ করা যায়। যারা দাবি করে যে ইসলামী (মৌলিক) কিতাব-পত্র ও মুর্শীদের কোনো প্রয়োজন নেই, তারা প্রকৃতপ্রস্তাবে মিথ্যুক নতুবা যিনদিক্ব। তারা মুসলমানদেরকে ধোকা দেয় এবং ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ধর্মীয় বইপত্রের জ্ঞান বের করা হয় ক্বুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ হতে।’ {ইমাম আবদুল গনী নাবলুসী কৃত ‘হাদীক্বা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো। তিনি ১১৪৩ হিজরী মোতাবেক ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে বেসালপ্রাপ্ত হন।}



আল্লাহতায়া'লা তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)’কে প্রেরণ করেন যাতে তিনি (হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ক্বুরআন মজীদের বাণী পৌঁছে দিতে পারেন এবং তা শিক্ষাও দিতে পারেন। মহানবী (ﷺ)’র কাছ থেকে (সরাসরি) আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه) ক্বুরআনুল করীমের জ্ঞান শিক্ষা করেন। উলামায়ে ইসলাম তা শিক্ষা করেন সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) হতে; আর মুসলমানবৃন্দ তা শেখেন ইসলামী উলামা-মণ্ডলী ও তাঁদের বইপত্র হতে।



একটি হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে:



الْعِلْمُ خَزَائِنُ وَتَفْتَحُهَا الْمَسْأَلَةُ



❏ “জ্ঞান হলো এক ধনাগার, এর চাবিকাঠি জিজ্ঞেস করে শেখা” (দারেমী: আস্ সুনান, ২:১০৩, হাদীস নং ৫৫৮);



تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ وَعَلِّمُوهُ النَّاسَ



❏ “জ্ঞান শিক্ষা করো এবং শিক্ষা দাও!”



(ক/ দারেমী: আস্ সুনান, ১:২৫০, হাদীস নং ২২৭; খ/ আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবীহ, ১:৫৯, হাদীস নং ২৫৯; গ/ বায়হাকী: শু‘য়াবুল ইমান, ৪:২৬৫, হাদীস নং ১৭০১; ঘ/ দারে কুতনী: আস্ সুনান, ৯:৩৭৯, হাদীস নং ৪১৪৯)



لِكُلِّ شَيْءٍ مَعْدِنٌ , وَمَعْدِنُ التَّقْوَى قُلُوبُ الْعَارِفِينَ



❏ “প্রতিটি বস্তুরই রয়েছে উৎস; তাক্বওয়া (মানে খোদাভীরুতা)’র উৎস হলো ‘আরেফ/খোদা-জ্ঞানীদের অন্তরসমূহ”


(তাবারানী: আল-মু‘জামুল কাবীর, ১০:৪৪৩);



تَعْلِيْمُ العِلْمِ كَفَّارةْ لِلْكَبَائِرْ



❏ “জ্ঞান শিক্ষাদানে পাপ মোচন হয়।”



❏ ইমামে রব্বানী শায়খ আহমদ ফারূক্বী সেরহিন্দী  (رحمة الله) তাঁর রচিত ‘মকতুবাত শরীফ’ পুস্তকের প্রথম খণ্ডের ১৯৩তম পত্রে লেখেন:



“কোনো দায়িত্বশীল (বালেগ/সাবালক) ব্যক্তিকে প্রথমে তাঁর ঈমান তথা আক্বীদা-বিশ্বাস পরিশুদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের জ্ঞান বিশারদবৃন্দের শেখানো আক্বীদা-বিশ্বাস জেনে তা অন্তরে ধারণ করা উচিত। আল্লাহতায়া'লা ওই মহান ব্যক্তিত্বদের সাধনার জন্যে তাঁদেরকে প্রচুর সওয়াব দিন, আমীন। এ সকল মহৎ ব্যক্তি সঠিকভাবে যে (ধর্মীয়) জ্ঞান (গবেষণা করে) বের করেছেন, স্রেফ তা শিক্ষা করা এবং তাতে বিশ্বাস করার ওপরই পরকালীন শাস্তি হতে মুক্তি লাভ নির্ভরশীল {তাঁদের পথের অনুসারীদের বলা হয় সুন্নী}। একটি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে যে জাহান্নামের আগুন থেকে একটি দল নাজাত/পরিত্রাণ পাবে; আর এটা সেই মুসলমানদের দল যাঁরা (ওপরোক্ত) উলামাবৃন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। রাসূলে খোদা (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ (رضي الله عنه)’কে অনুসরণকারী প্রকৃত মুসলমান হচ্ছেন কেবল এসব মুসলমান-ই। ক্বুরঅান মজীদ ও হাদীস শরীফ হতে বের করা (বিধিবিধান-সংক্রান্ত) সঠিক ও মূল্যবান জ্ঞান সেগুলোই, যা আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদমণ্ডলী ক্বুরআন-হাদীস থেকে (গবেষণা করে) বের করেছেন। কেননা ধর্মক্ষেত্রে মুসলমান নামধারী প্রতিটি পথভ্রষ্ট লোকই দাবি করে থাকে যে তার গোমরাহ ধ্যান-ধারণা ক্বুরআন-হাদীস থেকে গৃহীত হয়েছে। ভ্রান্ত চিন্তা ও বিচ্যুত আক্বীদা-বিশ্বাসের ধারক প্রত্যেকেই বলে সে ক্বুরআন-সুন্নাহ’র অনুসারী। তবে এটা পরিদৃষ্ট হয়েছে যে, ক্বুরআন-হাদীস থেকে উপলুব্ধ (জ্ঞান) ও বের করা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সবাই কিন্তু সঠিক নয়।



{আল্লামা হুসাইন হিলমীর নোট: আহলে সুন্নাতের সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস শিক্ষা করার বেলায় হানাফী মাযহাবের মহান ইসলামী বিদ্বান হযরত ফযলুল্লাহ বিন হাসান তুর পুশতী (বেসাল:৬৬১ হিজরী/১২৬৩ খৃষ্টাব্দ) বিরচিত ‘আল-মো’তামাদ’ শীর্ষক বইটি অগ্রগণ্য; এটা আহলে সুন্নাতের উলামাদের প্রচারিত প্রকৃত আক্বীদা-বিশ্বাস বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে। এর অর্থ স্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য। হাক্বীক্বত কিতাবাভী ১৪১০ হিজরী/১৯৮৯ খৃষ্টাব্দ সালে বইটি প্রকাশ করেছে।}



“আক্বায়েদ সঠিকভাবে শেখার পর আমাদেরকে ‘হালা’ল’, ’হারা’ম’, ‘ফরয’, ‘ওয়াজিব’, ‘সুন্নাত’, ‘মানদুব’ ও ‘মকরূহ’-গুলো সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের লেখা ফেক্বাহ’র বইপত্র হতে শিক্ষা ও তা মান্য করা উচিত। এ সকল মহান উলামাকে বুঝতে অক্ষম গণ্ডমূর্খ লোকদের প্রকাশিত গোমরাহ-পথভ্রষ্ট বইপত্র আমাদের পাঠ করা উচিত নয়। আক্বায়েদে আহলে সুন্নাতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ আক্বীদা-বিশ্বাসধারী মুসলমানবর্গ পরলোকে জাহান্নাম হতে বাঁচতে পারবে না – আল্লাহতায়া'লা আমাদের রক্ষা করুন! সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণকারী মুসলমান যদি এবাদত-বন্দেগীতে তথা ধর্মানুশীলনে শিথিল হন, তাঁকে হয়তো মাফ করা হতে পারে, যদি তিনি তওবা না-ও করে যেতে পারেন। আর মাফ না করা হলে জাহান্নামে শাস্তি লাভের পরে তিনি মুক্তি পাবেন। মূল বিষয় হলো আক্বীদা-বিশ্বাস পরিশুদ্ধ করা। হযরত খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার (বেসাল: ৮৯৫ হিজরী/১৪৯০ খৃষ্টাব্দ, সমরক্বন্দ) বলেন, ‘আমাকে যদি সমস্ত কাশফ ও কারামত দেয়া হতো কিন্তু আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস হতে বঞ্চিত করা হতো, তাহলে আমি নিজেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিবেচনা করতাম। (পক্ষান্তরে) আমার যদি কোনো কাশফ-কারামত না থাকতো অথচ থাকতো অনেক দোষত্রুটি, আর যদি আমাকে আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস দ্বারা আশীর্বাদধন্য করা হতো, তাহলেও আমি অনুতপ্ত হতাম না।’



“আজকে ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের অধঃপতিত অবস্থা। ইসলামের শত্রুরা চারদিক থেকে তাদেরকে আক্রমণ করছে। বর্তমানে দ্বীনের সেবায় একটি মুদ্রা দান করা অন্য যে কোনো সময়ের সহস্র সহস্র মুদ্রা দানের চেয়েও বেশি সওয়াবদায়ক। ইসলাম ধর্মের জন্যে সবচেয়ে বড় খেদমত হবে আহলে সুন্নাতের বইপত্র, যা ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়, তা সংগ্রহ করা এবং গ্রামবাসী ও তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিতরণ করা। যে ব্যক্তির ভাগ্যে এই পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য নসীব হয়েছে, তিনি অবশ্যই খুশি অনুভব করবেন; তিনি আল্লাহতায়া'লার প্রতি অগণিত কৃতজ্ঞতা জানাবেন; তিনি যে কী সৌভাগ্যবান, কতোখানি উত্তম তাকদীরের অধিকারী! ইসলাম ধর্মের খেদমত আঞ্জাম দেয়া সব সময়-ই ভালো। কিন্তু এ রকম ক্রান্তিকালে যখন দ্বীন-ইসলামের পরিস্থিতি নাজুক ও দুর্বল, যখন মিথ্যের বেসাতি ও কুৎসা রটনার মাধ্যমে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার অনেক অপচেষ্টা চলছে, তখন আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস প্রচার করাটা অনেক উত্তম একটা কাজ।



❏ রাসূলে পাক (ﷺ) তাঁর সাহাবা-মণ্ডলী (رضي الله عنه)’কে বলেন:



إِنَّكُمْ فِي زَمَانٍ مَنْ تَرَكَ مِنْكُمْ عُشْرَ مَا أُمِرَ بِهِ هَلَكَ ثُمَّ يَأْتِي زَمَانٌ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ بِعُشْرِ مَا أُمِرَ بِهِ نَجَا



‘তোমরা এমন এক সময়ে জীবন যাপন করছো যখন অাল্লাহতায়া'লার আদেশ-নিষেধের নয়-দশমাংশ তোমরা মান্য করা সত্ত্বেও যদি এক-দশমাংশ অমান্য করো, তাহলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে! আর তোমাদের পরে এমন এক সময় আসবে যখন স্রেফ (শরীয়তের আদেশ-নিষেধের) এক-দশমাংশ যারা মান্য করবে তারাই নাজাত পাবে’



🔺{নোট: এ হাদীস লিপিবদ্ধ আছে মিশকা’তুল মাসা’বিহ ১ম খণ্ড, ১৭৯ অনুচ্ছেদে; তিরমিযী, কিতাবুল ফিতান, ৭৯ অনুচ্ছেদে; তিরমিযী: আস্ সুনান, ৮:২২২, হাদীস নং ২১৯৩; এবং আল-খতীব: মিশকাতুল মাসাবিহ, ১:৩৯, হাদীস নং ১৭৯}।



হাদীস শরীফে যে সময়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হলো বর্তমান সময়কাল। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ইসলামের আক্রমণকারীদের চেনা এবং তাদেরকে অপছন্দ করা একান্ত জরুরি {নোট: জ্বেহাদ ক্বাতলী তথা শক্তি দ্বারা জ্বেহাদ পরিচালনা করে থাকে রাষ্ট্রপক্ষ ও তার সেনাবাহিনী। মুসলমানবৃন্দ তাতে শরীক হন সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে, যা রাষ্ট্রপক্ষ তাঁদের প্রতি অর্পণ করে। জ্বেহাদ ক্বওলী তথা কথা ও লেখনীর মাধ্যমে জ্বেহাদ যে জ্বেহাদ ক্বাতলী হতে শ্রেয়তর, তা লিপিবদ্ধ আছে ইমামে রব্বানী  (رحمة الله)’র মকতুবাত পুস্তকের ৬৫ নং পত্রে}। আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদদের বইপত্র ও বাণী প্রচার করার জন্যে কাউকে কারামত/অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বা আলেম হতে হবে না। প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তিরই এই লক্ষ্যে সংগ্রাম-সাধনা করা উচিত। এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়। শেষ বিচার দিবসে প্রত্যেক মুসলমানকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে এবং প্রশ্ন করা হবে কেন তারা ইসলামের খেদমত করেনি। যারা ইসলামী শিক্ষামূলক বইপত্র বিতরণে সাধনা করে না এবং যারা ইসলামী জ্ঞান প্রচারকারী মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য-সহায়তা করে না, তাদেরকে ভীষণ শাস্তি দেয়া হবে। কোনো রকম ওজর-আপত্তি গ্রাহ্য করা হবে না। আম্বিয়া (عليه السلام) যদিও সবচেয়ে সম্মানিত ও সৃষ্টিকুলসেরা, তথাপিও তাঁরা কখনো নিজেদের আরাম-আয়েশের দিকে নজর দেননি। অনন্ত নেআমত/আশীর্বাদপ্রাপ্তির পথ আল্লাহতায়া'লার ধর্মকে প্রচার করার উদ্দেশ্যে তাঁরা দিন-রাত সাধনা করেছেন। যারা তাঁদের কাছে অলৌকিক ক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলো, তাদের প্রতি তাঁরা উত্তর দিয়েছিলেন যে ‘আল্লাহতায়া'লা মো’জেযা/অলৌাকক ক্রিয়া সৃষ্টি করেছেন, আর তাঁদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর ধর্মকে (মানুষের কাছে) পৌঁছে দেয়া।’ যেহেতু তাঁরা এই উদ্দেশ্যে কাজ করেছিলেন, সেহেতু আল্লাহতায়া'লা তাঁদেরকে সাহায্য করেন এবং মো’জেযা সৃষ্টি করে দেন। আমাদেরও উচিত আহলে সুন্নাতের বিদ্বানমণ্ডলীর বইপত্র ও বাণী প্রচার করা এবং তরুণ প্রজন্ম ও আমাদের বন্ধুদেরকে অবিশ্বাসী শত্রুদের হীনতা এবং মুসলমানদের প্রতি আরোপিত তাদের মিথ্যে ও কুৎসা এবং হয়রানি সম্পর্কে জানানো



❏ {নোট: মুসলমানদেরকে তা জানানো গুজব নয়, বরং


الَأْمْرُ بِالْمَعْرُفِ وَالنَهْيُ عَنْ الْمُنْكَرُ


আল-আমরু বিল-মা’রূফ ওয়ান্ নাহী আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ।}



প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত আহলে সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস শিক্ষা করা এবং যেসব মানুষের ওপর তাঁর প্রভাব বিদ্যমান তাদেরকেও শেখানো। সুন্নী উলামাবৃন্দের বাণীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসম্বলিত বইপত্র, ম্যাগাজিন ও প্রচারপত্র কেনা উচিত এবং তরুণ দ্বীনী ভাইবোন ও পরিচিতজনের মাঝে বিলিবণ্টন করা উচিত। তাঁরা যাতে সেগুলো পাঠ করেন, তা নিশ্চিত করতে আমাদের কঠিন পরিশ্রম করা উচিত। এছাড়া ইসলামের শত্রুদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনাকারী বইপত্রও বিতরণ করা উচিত}। যারা এই লক্ষ্যে ধনসম্পদ ব্যয় ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে না বা পেশাগত শ্রম দেয় না, তারা শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। এই উদ্দেশ্যে কাজ করার সময় দুঃখকষ্ট ভোগ ও হয়রানির শিকার হওয়াকে এক মহা সুখের বিষয় ও বড় ফায়দা হিসেবে গণ্য করতে হবে। পয়গম্বর (عليه السلام)’বৃন্দ মানুষের কাছে আল্লাহতায়া'লার বিধান পৌঁছে দেয়ার সময় মূর্খ ও হীন লোকদের আক্রমণের শিকার হন। তাঁরা প্রচুর কষ্টভোগ করেন। আল্লাহতায়া'লার প্রিয়নবী (ﷺ) যাঁকে নবীকুলশ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো, তিনি এরশাদ করেন – ‘কোনো পয়গম্বর-ই আমার মতো রূঢ় ব্যবহার দ্বারা কষ্টভোগ করেননি।’ {ইমাম রব্বানী  (رحمة الله)’র মকতুবাত পুস্তকের উদ্ধৃতি এখানে সমাপ্ত হলো}]



হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) এর শরীয়ত শিক্ষা করার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন ও পৃথিবীর বুকে সকল মুসলমানকে সঠিক পথপ্রাপ্তির দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন চারজন মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁদের একজন হলেন ইমামুল আযম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত  (رحمة الله)। তিনি ইসলামী উলামামণ্ডলীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আহলে সুন্নাতের তিনি-ই একজন ইমাম। তাঁর জন্ম কুফা নগরীতে ৮০ হিজরী সালে (৬৯৯ খ্রী:)। তিনি ১৫০ হিজরী সালে (৭৬৭ খ্রী:) বাগদাদে বেসালপ্রাপ্ত হন।



উলামাবৃন্দের মধ্যে দ্বিতীয় জন হলেন ইমাম মালেক ইবনে আনাস্  (رحمة الله)। তিনি ৯৫ হিজরী সালে (৯১৩ খ্রী:) মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ  করেন এবং সেখানেই ১৭৯ হিজরী (৭৯৫ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।



তৃতীয় জন হলেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস্ শাফেয়ী  (رحمة الله), যিনি ইসলামী জ্ঞান বিশারদগণের নয়নমণি। তিনি প্যালেস্টাইনের গাযায় ১৫০ হিজরী (৭৬৭ খ্রী:) সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিসরে ২০৪ হিজরী (৮১৯ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন।



চতুর্থ জন হলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল  (رحمة الله) যিনি বাগদাদ নগরীতে ১৬৪ হিজরী (৭৮০ খ্রী:) সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই ২৪১ হিজরী (৮৫৫ খ্রী:) সালে বেসালপ্রাপ্ত হন। তিনি-ই ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ইমারতের ভিত্তিপ্রস্তর।



আজকাল যারা এই চারজন ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করে না, তারা মহাবিপদে পতিত। বস্তুতঃ তারা গোমরাহীতে নিমজ্জিত। এই চারজন ইমাম ছাড়াও আরও অনেক সত্যপন্থী মযহাবের ইমাম ছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমণে তাঁদের মযহাব বিস্মৃত হয়েছে এবং বইপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, মদীনা শরীফের সাতজন উলামা যাঁদের “আল্ ফুকাহা আস্ সাব’আ” বলা হতো, তাঁরা এবং হযরত উমর ইবনে আবদিল আযীয  (رحمة الله), হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না  (رحمة الله), হযরত ইসহাক ইবন রাহাউয়ীয়্যা  (رحمة الله), হযরত দাউদ আত-তায়ী  (رحمة الله), হযরত আমীর ইবনে শারাহিল আশ্ শা’বী (رحمة الله), হযরত লাইস্ ইবনে সা’দ  (رحمة الله), হযরত আ’মাশ  (رحمة الله), হযরত মুহাম্মদ ইবনে জারির তাবারী  (رحمة الله), হযরত সুফিয়ান সাওরী  (رحمة الله) ও হযরত আবদুর রহমান আওযাই  (رحمة الله) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম ওরকম মযহাবের স্রষ্টা ছিলেন।



প্রিয়নবী (ﷺ)-এর সকল সাহাবী-ই বাস্তবিক অর্থে হেদায়াত (পথপ্রাপ্তি)-এর “উজ্জ্বল নক্ষত্র”। সারা পৃথিবীকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্যে তাঁদের যে কোনো একজন-ই যথেষ্ট। তাঁরা ছিলেন মুজতাহিদ, যাঁদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র মযহাব ছিল। তাঁদের অধিকাংশ মযহাব-ই অনুরূপ ছিল। তবু যেহেতু তাঁদের মযহাবগুলো বইপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়নি, সেহেতু আমাদের পক্ষে সেগুলো অনুসরণ করা সম্ভব নয়। চারজন ইমামের মযহাবগুলো, অর্থাৎ, বিশ্বাস সংক্রান্ত ও কর্ম (আমল) সংক্রান্ত তাঁদের বর্ণিত বিষয়াবলী তাঁদের শিষ্যবৃন্দ কর্তৃক সংগৃহীত এবং ব্যাখ্যাকৃত হয়েছে। সেগুলো বইপত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক মুসলমানকে উপরোক্ত চারজন ইমামের যে কোনো একজনের মযহাব অনুসরণ করতে হয় এবং সেই মযহাব অনুযায়ী জীবনযাপন ও এবাদত-বন্দেগী পালন করতে হয়।



ঈমানের জ্ঞানে এই চারজন ইমামের দু জন শিষ্য অত্যন্ত উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। ফলে ঈমান তথা এ’তেকাদের ক্ষেত্রে দুইটি মযহাব জন্মলাভ করে। কুরআন ও হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সঠিক ঈমান হলো সেটাই, যেটা ওই দু জন ইমাম প্রদর্শন করেছেন। বস্তুতঃ পরিত্রাণপ্রাপ্ত সম্প্রদায় আহলুস্ সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাস ওই দু জন ইমাম-ই সারা পৃথিবীতে প্রচার-প্রসার করেন। তাঁদের একজন হলেন ইমাম আবুল হাসান আলী আল্ আশআরী  (رحمة الله) যিনি ২২৬ হিজরী (৪৭৯ খ্রী:) সালে বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৩০ হিজরী (৯৪১ খ্রী:) সালে বাগোদে বেসালপ্রাপ্ত হন। অপর জনের নাম ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি  (رحمة الله) যিনি ৩৩৩ হিজরী (৯৪৪ খ্রী:) সালে সমরকন্দ অঞ্চলে বেসালপ্রাপ্ত হন। ঈমানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক মুসলমানকেই এই দু জন ইমামের কোনো একজনকে অনুসরণ করতে হয়।



আউলিয়ায়ে কেরামের তুরুক (তরীকা বা রাস্তার বহুবচন) সত্য, সঠিক। তাঁরা শরীয়ত হতে এক বিন্দুও বিচ্যুত হননি। আউলিয়াবৃন্দ কারামত (অলৌকিক ক্রিয়া)-এর অধিকারী। তাঁদের সকল কারামত-ই সত্য এবং সঠিক।



❏ মহান আলেম ইমাম ইয়াফি’ই  (رحمة الله) বলেছেন, وَانْتَشَرَتِ كَرَامَاتَ غَوْثِ الثَفَلَيْنِ عَبْدِ القَادِرِ الْجِيْلاَنِيْ اِلَيْ كُلِّ الاَنْحَاءِ وَكَانَتْ تَنْتَقِلُ مِنَ الفَمِّ اِليْ الفَمِ بِشِكْلِ لاَ يَمْكِنُ اَنْكَارَهَا وَالْشُّبهَةَ فِيْهَا لأَنَّ التَّوَاتُرَ فِيْهَا يَعْنِيْ الأِنْتِشَارُ فِيْ كُلِّ مَكَانٍ يَعْتَبِرُ سَنْدَا قَوِيًا لَهَا. –


“গাউস্ আস্ সাকলাইন হযরত মওলানা আবদুল কাদির আল জিলানী  (رحمة الله)-এর কারামতসমূহ এতো সর্বজনবিদিত ও সর্বত্র প্রসার লাভকৃত যে, কেউ এতে সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাস পোষণ করতে পারে না। কেননা, ’তাওয়াতুর’ (সর্বত্র প্রসার লাভকৃত অবস্থা) হলো সত্যতার একটি সনদ (প্রামাণ্য দলিল)।”



নামায আদায়কারী কোনো ব্যক্তিকে “কাফের” (অবিশ্বাসী) আখ্যা দেয়া আমাদের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, যদি না আমরা তাকে কুফর বা অবিশ্বাস সৃষ্টিকারী কোনো কথা বলতে শুনি অথবা কাজ করতে দেখি। সেই ব্যক্তির কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে না জেনে আমরা লা’নত (অভিসম্পাত) দিতে পারি না। এমন কি একজন কাফের (ভিন্ন ধর্মাবলম্বী)-কেও লা’নত দেয়া অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এ কারণে ইয়াযিদকে লা’নত না দেয়া-ই উত্তম।

_____________

কিতাবঃ ঈমান ও ইসলাম

মূল: মওলানা খালেদ আল-বাগদাদী  (رحمة الله)  

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন