যে ব্যক্তি দাবি করে এখনো এজতেহাদ প্রয়োগ করা জরুরি, সে নিশ্চয় পাগল, অথবা ধর্মের ব্যাপারে অজ্ঞ।
▶মহান ইমাম জালা’লউদ্দীন সৈয়ূতী (বেসাল: ৯১১ হিজরী/১৫০৫ খৃষ্টাব্দ, মিসর) যখন দাবি করেন তিনি এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন, তখন অন্যান্য সমসাময়িক আলেম-উলামা তাঁকে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেন যেটার বেলায় দুইটি পৃথক উত্তর (ইতিপূর্বে) দেয়া হয়েছিলো, আর তাঁরা ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله)’র কাছে জানতে চান কোন্ উত্তরটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য। তিনি তাঁদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন এর উত্তর দেয়ার মতো সময় তাঁর হাতে নেই, কেননা তিনি ভীষণ ব্যস্ত। অথচ তাঁকে বলা হয়েছিলো একটি ফতোয়ার ক্ষেত্রে এজতেহাদ প্রয়োগ করতে, যে কাজটা এজতেহাদের সর্বনিম্ন পর্যায়ের। ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله)’র মতো গভীর জ্ঞানী আলেমকে ফতোয়ার ক্ষেত্রে এজতেহাদ প্রয়োগ এড়িয়ে যেতে দেখে আমরা ওই সব লোককে কী বলে ডাকবো – যদি না তাদেরকে আমরা উন্মাদ বা আত্মিকভাবে মূর্খ বলে ডাকি – যারা মুতলাক্ব (স্বয়ংসম্পূর্ণ) এজতেহাদ প্রয়োগ করতে মানুষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে?
▶ ইমাম গাযযালী (বেসাল: ৫০৫ হিজরী/১১১১ খৃষ্টাব্দ, তুস নগরী) তাঁর ‘এহইয়া’-এ-উলূম আল-দ্বীন’ পুস্তকে বর্ণনা করেন যে,
امَا مَنْ لَيْسَ لَهُ رُتْبَةُ الاِجْتِهَادِ
তাঁর সময়ে কোনো (মুতলাক্ব) মুজতাহিদ ছিলেন না।
“কোনো অ-মুজতাহিদ মুসলমান যদি একটি সহীহ হাদীস সম্পর্কে জানতে পারেন এবং যদি (কোনো মাসআলায়) হাদীসটির সাথে মতভেদকারী তাঁর নিজ মাযহাবের ইমাম সাহেবের প্রয়োগকৃত এজতেহাদ অনুযায়ী অনুশীলন করা তাঁর জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তিনি চার মাযহাবের কোনোটির অন্তর্ভুক্ত এমন আরেকজন মুজতাহিদকে খুঁজে বের করতে পারেন যাঁর এজতেহাদ ওই হাদীসটির ওপর ভিত্তিশীল, আর তখন ওই বিষয়টি তিনি সেই মুজতাহিদের মাযহাব অনুযায়ী পালন করতে পারেন।
▶মহান ইমাম নববী (বেসাল: ৬৭৬ হিজরী/১২৭৭ খৃষ্টাব্দ, দামেশক) তাঁর প্রণীত ‘রওদাত আত্ তালেবীন’ গ্রন্থে এই বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। কেননা যারা এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি, তাদের জন্যে নস তথা ক্বুরআন-সুন্নাহ হতে (শরঈ) বিধিবিধান বের করার কোনো অনুমতি-ই নেই।
বর্তমানে কিছু গণ্ডমূর্খ লোক দাবি করে তারা মুতলাক্ব এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে; আর তারা নস হতে আইনকানুন বের করতেও সক্ষম; অধিকন্তু চার মাযহাবের কোনোটির অনুসরণ তাদের আর এখন প্রয়োজন নেই। অতঃপর তারা বহু বছর ধরে তাদেরই অনুসৃত মাযহাবের অনুসরণকে পরিহার করে। তাদের অনির্ভরযোগ্য চিন্তাধারার সাহায্যে তারা মাযহাবগুলোকে খণ্ডন করার অপচেষ্টাও চালায়। তারা এই আহাম্মকীপূর্ণ দাবি উত্থাপন করে, ‘আমরা এমন আলেমের মতামত অনুসরণ করবো না যিনি ছিলেন আমাদের মতোই অজ্ঞ।’ শয়তানের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত হয়ে এবং নফসের উস্কানি পেযে তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ দাবি করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না এ কথা দাবি করে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে না, বরং নিজেদের বেয়াকুফি ও অপকীর্তি-ই প্রকাশ করে। এদের মধ্যে আমরা সেসব গোমরাহ মূর্খ লোককেও দেখতে পাই যারা বলে ও লিখে যে প্রত্যেকের উচিত তাফসীর বইপত্র ও সহীহ বুখারী হাদীসগ্রন্থ হতে আইনকানুন বের করা। হে আমার মুসলিম ভাইয়েরা, এ ধরনের আহাম্মকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন সম্পূর্ণভাবে পরিহার করুন, আর তাদেরকে আলেম-এ-দ্বীন মনে করাও বাদ দিন! বরঞ্চ আপনাদের ইমামের মাযহাবকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন! চার মাযহাবের যে কোনোটি বেছে নেয়ার ব্যাপারে আপনারা স্বাধীন। কিন্তু মাযহাবগুলোর রুখসাত তথা সহজ পদ্ধতিগুলো জড়ো করে তালফীক্ব বা মাযহাবগুলোর একীভবন/একত্রে মিশ্রণ জায়েয নেই। {নোট: তালফীক্ব অর্থ ’কোনো আমল পালনের সময় মাযহাবগুলোর সহজ পদ্ধতিগুলো এমনভাবে একত্রে মিশ্রণ করা যা চার মাযহাবের কোনোটির সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’ চার মাযহাবের কোনো একটির পদ্ধতি অনুসারে কোনো আমল/অনুশীলনী কেউ পালন করার পর, অর্থাৎ, সেই মাযহাবে তাঁর পালিত আমল সহীহ (সঠিক, বৈধ) হওয়ার পর এতদসংক্রান্ত আমলের সহীহ হবার জন্যে অন্য তিন মাযহাবে আরোপিত শর্তাবলী যথাসম্ভব অতিরিক্ত হিসেবে পালন করার মানসে তিনি তা অনুশীলন করলে এটাকে বলা হয় ‘তাক্বওয়া’ (পরহেযগারী); এটা পুরস্কারের যোগ্য।}
“যে মুসলমান ব্যক্তি হাদীসশাস্ত্র পাঠ করে তা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম, তাঁর উচিত নিজের অনুসৃত মাযহাবের দলিলস্বরূপ বিদ্যমান হাদীসগুলো শিক্ষা করা; অতঃপর তাঁর উচিত ওই আহাদীসে প্রশংসিত (পুণ্যদায়ক) কাজগুলো পালন করা ও নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিহার করা; এরপর জ্ঞানার্জন করা দ্বীন-ইসলামের মাহাত্ম্য ও মূল্য সম্পর্কে; আল্লাহতায়া'লা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নামসমূহ ও গুণাবলীর পূর্ণতা/শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে; মহানবী (ﷺ)’র জীবন, তাঁর (সত্তাগত) উন্নত বৈশিষ্ট্যাবলী ও মো’জেযা/অলৌকিকত্ব সম্পর্কে; ইহ-জগৎ ও পরলোকের বিষয়াদি ও সুবিন্যস্ততা সম্পর্কে; আর পুনরুত্থান, (শেষ) বিচার, বেহেস্ত ও দোযখ, ফেরেশতা ও জ্বিন, পূর্ববর্তী (আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের) উম্মতবর্গ, পয়গম্বরবৃন্দ (عليه السلام) ও তাঁদের আসমানী কেতাবসমূহ, রাসূলে পাক (ﷺ) ও ক্বুরআন মজীদের সুনির্দিষ্ট (খাস) শ্রেষ্ঠত্বসমূহ, আহলে বায়তে নববী (رضي الله عنه) ও আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه)’এর জীবন, প্রলয় দিবসের আলামতগুলো এবং এই জগৎ ও পরবর্তী জগতের অন্যান্য তথ্যাদি সম্পর্কেও। এই দুনিয়া ও আখেরাত সম্পর্কে সমস্ত তথ্য সংকলিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর আহাদীস পাকে।
“আমরা এখানে যা লিপিবদ্ধ করেছি তা বোধগম্য হলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় ওইসব লোক কতোখানি মূর্খ, যারা বলে হাদীস শরীফ হতে বের করা নয় এমন ইসলামী বিধিবিধান অর্থহীন বা অকার্যকর। হাদীসগুলোতে প্রদত্ত অসংখ্য তথ্যের মধ্যে এবাদত-বন্দেগী ও মু’আমালা’ত শিক্ষাদানকারী হাদীসের সংখ্যা খুবই অল্প/নগণ্য। কতিপয় আলেমের মতানুসারে, এগুলো (মাত্র) পাঁচ শ (পুনরাবৃত্তি হয়েছে এমন হাদীস পরিগণিত হলে এই সংখ্যা তিন সহস্রের বেশি নয়)। এতো কম সংখ্যক হাদীসের মধ্যে চার মাযহাবের ইমামবৃন্দের কেউ একজন একটি সহীহ হাদীস হয়তো শোনেননি, এমনটি মোটেও ধারণাযোগ্য নয়। প্রতিটি সহীহ হাদীসকেই চার আ’ইম্মায়ে মাযা’হিবের অন্ততঃ একজন হলেও দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যে মুসলমান ব্যক্তি নিজের অনুসৃত মাযহাবের কিছু বিষয়কে কোনো সহীহ হাদীসের সাথে অসুবিধাজনক হিসেবে দেখতে পান, তাঁর উচিত ওই বিষয়টি এমন আরেকটি মাযহাবকে অনুসরণ করে সমাধা করা, যেটার এজতেহাদ (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত/রায়) ওই হাদীসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হয়তো তাঁর মাযহাবের ইমাম সাহেবও হাদীসটি শুনেছেন, তবে অন্য কোনো হাদীস যেটাকে তিনি আরো সহীহ হিসেবে পেয়েছেন বা জেনেছেন, অথবা সেটা (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বিবৃত) পরবর্তীকালের হাদীস যেটা পূর্ববর্তী হাদীসকে রহিত করেছে (বলে তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে), কিংবা মুজতাহিদবৃন্দের জ্ঞাত অন্যান্য কারণে তিনি পূর্ববর্তী ওই হাদীসটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেননি। পূর্ববর্তী হাদীসটি যে সহীহ, তা উপলব্ধিকারী মুসলমানের জন্যে হাদীসটির সাথে অসুবিধাজনক নিজের মাযহাবের এজতেহাদকে ত্যাগ করে ওই হাদীসটি অনুসরণ করা উত্তম, তবে এক্ষেত্রে তাঁকে অন্য আরেকটি মাযহাবের এজতেহাদের অনুসরণ করতে হবে যেটা ওই হাদীসের ওপর ভিত্তিশীল। কেননা ওই দ্বিতীয় মাযহাবটির ইমাম সাহেব অাহকাম তথা বিধিবিধানের দলিলগুলো, যা সম্পর্কে মুসলমান ব্যক্তিটির জানা নেই, তা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেফহাল হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে ওই হাদীসের ওপর ভিত্তি করে আমল করার বেলায় কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা নেই। তথাপি ওই মুসলমানের জন্যে নিজের মাযহাবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সমাধা করারও অনুমতি রয়েছে; কেননা তাঁর নিজের মাযহাবের ইমাম সাহেবও তাঁর এজতেহাদ প্রয়োগের সময় মজবুত দলিলের ওপর নির্ভর করেছেন। কোনো মুক্বাল্লিদের জন্যে ওই দলিল না জানার ওজরকে ইসলাম ধর্ম অনুমতি দেয়। এটা এ কারণে যে চার মাযহাবের কোনো ইমামই এজতেহাদের ক্ষেত্রে ক্বুরআন-সুন্নাহকে ছাড়িয়ে যাননি। তাঁদের মাযহাবগুলো হলো আল-ক্বুরআন ও সুন্নাহরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তাঁরা ক্বুরআন-সুন্নাহতে অন্তর্নিহিত অর্থ ও বিধিবিধান মুসলমান সমাজের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন এমনভাবে যাতে মুসলমানবৃন্দ তা সহজে বুঝতে পারেন; আর এই লক্ষ্যে তাঁরা সেগুলো বইপত্রে লিপিবদ্ধ করেছেন। আ’ইম্মায়ে মাযা’হিব (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)’এর এই অবদানটি ইসলামের এতো বড় খেদমত ছিলো যে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া মানবের সামর্থ্যে এটা কোনোক্রমেই কুলোতো না। এসব মাযহাবের অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে এ বাস্তবতাকেই প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হচ্ছেন (আল্লাহর) প্রকৃত পয়গম্বর এবং দ্বীন-ইসলাম তাঁরই সত্য ধর্ম।
“আমাদের আ’ইম্মাত আল-মাযা’হিবের (চার মাযহাবের চারজন ইমামের) এজতেহাদী মতপার্থক্য ছিলো কেবল ফুরূ’ আদ-দ্বীন (ধর্মের আনুষঙ্গিক) বিষয়াদির ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, তা ছিলো ফেক্বাহ-সংক্রান্ত মতােনৈক্য। কিন্তু উসূলে দ্বীন তথা ঈমান-আক্বীদা সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে কোনো মতভেদ ছিলো না। অধিকন্তু, তাঁদের মধ্যে মতান্তর ছিলো না সেসব ফুরূ’-বিষয়ক শিক্ষার বেলায়ও, যেগুলো ছিলো ধর্মের আবশ্যকীয় অংশ এবং যেগুলো তাওয়াতুর/সর্বজনজ্ঞাত প্রামাণিক আহাদীস দ্বারা ছিলো সমর্থিত। ফুরূ’ আদ-দ্বীন সংক্রান্ত কিছু কিছু জ্ঞানের শাখা নিয়েই শুধু তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিলো। এসব বিষয়ে দালিলিক প্রমাণাদির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে তাঁদের উপলব্ধির পার্থক্য হতেই এর সূত্রপাত হয়েছিলো। আর তাঁদের মধ্যে এই সামান্য মতপার্থক্য হচ্ছে উম্মতের প্রতি (আল্লাহতায়া'লার) রহমত-বিশেষ; মুসলমানবৃন্দ যে মাযহাব পছন্দ করেন এবং তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তা-ই অনুসরণ করার অনুমতি (জায়েয) তাঁদের রয়েছে। রাসূলে খোদা (ﷺ) এই মতপার্থক্যের খোশ-খবরী দিয়েছিলেন, আর তিনি যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঠিক সেভাবেই ঘটেছে।
“এ’তেক্বাদ-সংক্রান্ত জ্ঞান তথা যেসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, সেগুলোর ব্যাপারে এজতেহাদ প্রয়োগের কোনো অনুমতি নেই। এ রকম করা হলে বিচ্যুতি ও গোমরাহী দেখা দেবে, যা মহাপাপ। এ’তেক্বাদের ক্ষেত্রে শুধু একটাই সঠিক পথ বিদ্যমান আর তা হলো ‘আহল আস্ সুন্নাত ওয়াল-জামাআত।’ (আল্লাহতায়া'লার) রহমত হিসেবে যে মতপার্থক্যকে হাদীস শরীফে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ফুরূ’ বা আহকাম-সংক্রান্ত পার্থক্য।
_____________
কিতাবঃ ঈমান ও ইসলাম
মূল: মওলানা খালেদ আল-বাগদাদী (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন