৪। ঈমানের ছয়টি মূলনীতির মধ্যে চতুর্থটি হলো وَرُسُلِهِ- “রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের প্রতি বিশ্বাস”– যাঁদের প্রেরণ করা হয়েছিল মানুষদেরকে আল্লাহ্ তায়া'লার পছন্দকৃত পথটি গ্রহণ করানোর উদ্দেশ্যে এবং তাদেরকে সঠিক পথের দিকে হেদায়াত দানের উদ্দেশ্যে। “রুসূল” (রাসূলের বহু বচন) হলেন “সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁদেরকে ঐশী বাণীসহ প্রেরণ করা হয়েছিল।” শরীয়তের পরিভাষায় রাসূল হলেন “সেই মহান, সম্মানিত পুণ্যাত্মা যাঁর স্বভাবচরিত্র, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা তাঁর সময়কার লোকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং যাঁর চরিত্র বদ কিংবা অপছন্দীয় স্বভাব দ্বারা কলুষিত নয়।” রাসূলবৃন্দের একটি গুণ হলো ‘আসমত’। অর্থাৎ, রেসালাত অথবা নবুয়্যতপ্রাপ্তির আগে কিংবা পরে তাঁরা কোনো বড় অথবা ছোট গুনাহ সংঘটন করেন না। নবুয়্যত সম্পর্কে তাঁদেরকে জানানোর পরে এবং তাঁদের নবুয়্যত সর্বজনজ্ঞাত ও সর্বত্র প্রসারিত না হওয়া পর্যন্ত অন্ধত্ব, বধিরতা এবং অনুরূপ ত্রুটি তাঁদেরকে গ্রাস করেনি। এতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে প্রত্যেক রাসূল (عليه السلام)-ই সাতটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন। এগুলো হচ্ছে “আমানা” (বিশ্বস্ততা), “সিদক্” (সত্যনিষ্ঠা), “তাবলীগ” (যোগাযোগ), “আদালা” (ন্যায়পরায়ণতা), “আসমত” (নিষ্পাপ), “ফাতানা” (ঐশী জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা) এবং “আমান আল-আযল্” (নবুয়্যত হতে পদচ্যুত হবার ভীতিমুক্ত)।
যে পয়গম্বর একটি নতুন শরীয়ত নিয়ে আসেন, তাঁকে “রাসূল” বলা হয়। যে পয়গম্বর কোনো নতুন শরীয়ত আনেন না, কিন্তু মানুষদেরকে পূর্ববর্তী শরীয়তের প্রতি আহবান করেন, তাঁকে বলা হয় “নবী”। আল্লাহতায়া'লার দ্বীনের প্রতি মানুষদেরকে আহবানের ক্ষেত্রে এবং তাঁর আজ্ঞাবলী তাবলীগ (প্রচার, পৌঁছানো) করার ক্ষেত্রে একজন নবী ও একজন রসূলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম ব্যতিক্রম ছাড়া-ই সত্যনিষ্ঠ ও নিবেদিত ছিলেন। যে ব্যক্তি তাঁদের কোনো একজনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে না, সে তাঁদের সকলেরই প্রতি অবিশ্বাসকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।
অত্যধিক এবাদত-বন্দেগী, ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকা, কষ্ট ভোগ কিংবা কঠোর পরিশ্রম দ্বারা নবুয়্যত অর্জন করা যায় না। এটা কেবলমাত্র আল্লাহতায়া'লার অনুগ্রহ ও মনোনয়ন দ্বারা-ই অর্জন করা যায়। নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলীর মাধ্যমে শরীয়তসমূহ প্রেরিত হয়েছিল যাতে করে মানুষদের বিষয়াবলী এ পৃথিবীতে ও পরলোকে যথাযথ এবং উপকারী হয়; আর যাতে এলোমেলো, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড হতে তাদেরকে বিরত রেখে হেদায়াত, পরিত্রাণ, সুখ-শান্তি অর্জনে তাদেরকে পরিচালনা করা যায়। যদিও রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের বহু শত্রু ছিল এবং তাঁরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন, তবু তাঁরা শত্রুদেরকে ভয় পাননি এবং বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়াবলী ও পালনীয় সৎকর্ম সংক্রান্ত খোদা তায়া'লার আজ্ঞাসমূহ মানুষদের কাছে প্রচার করার ক্ষেত্রে তাঁরা কাল বিলম্বও করেননি। আল্লাহতায়া'লা তাঁর রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দকে সত্যনিষ্ঠ ও নিবেদিত প্রতীয়মান করার উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে মু’জেযা দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। তাঁদের মু’জেযার বিরুদ্ধে কেউই দাঁড়াতে পারেনি। কোনো পয়গম্বরের কওম বা জাতিকে তাঁর “উম্মত” বলা হয়। শেষ বিচারের দিনে নবী-রসূলবৃন্দকে (عليه السلام) তাঁদের উম্মতদের জন্যে শাফায়াত (সুপারিশ) করার অনুমতি দেয়া হবে, আর তাঁদের শাফায়াতকে গ্রহণও করা হবে। আল্লাহতায়া'লা তাঁদের উম্মতদের মধ্যে উলামা (জ্ঞান বিশারদমণ্ডলী), সুলাহা (সৎকর্মশীল পুণ্যাত্মাবৃন্দ) ও আউলিয়া (আল্লাহর বন্ধুবান্ধব)-কেও শাফায়াত করার অনুমতি মঞ্জুর করবেন। আর তাঁদের শাফায়াতও গৃহীত হবে। নবী-রসূলমণ্ডলী (عليه السلام) তাঁদের মোবারক রওযায় এমন এক হায়াতে জীবিত আছেন, যা আমরা জানি না; তাঁদের দেহ মোবারক মাটিতে পচে না। এ কারণেই -
❏ একটি হাদীস্ শরীফে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এরশাদ ফরমান,
– الأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِي قُبُورِهِمْ يُصَلُّونَ.
– নবী আলাইহিমুস সালামমণ্ডলী তাঁদের রওযা শরীফে নামায পড়েন।
🔺[৬]
(ক) বাযযার : আল মুসনাদ, মুসানাদু আবী হামযা আনাস ইবনে মালিক, ১৩:২৯৯ হাদীস নং ৬৮৮৮।
(খ) আবু ইয়ালা : আল মুসনাদ, ৬:১৪৭ হাদীস নং ৩৪২৫।
কোনো নবী (عليه السلام)-এর মোবারক চোখ নিদ্রাগত হলেও তাঁর অন্তরের চক্ষু কিন্তু নিদ্রাগত হয় না। নবুয়্যত-এর দায়িত্ব পালনকালে এবং নবুয়্যতের মাহাত্ম্য ও গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে নবী আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দ সবাই সমান। উপরোক্ত সাতটি বৈশিষ্ট্য তাঁদের সবার মধ্যেই বিদ্যমান। নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দকে কখনোই তাঁদের নবুয়্যত হতে পদচ্যুত করা হয়নি। তবে আউলিয়াবৃন্দ হয়তো বেলায়াত হতে পদচ্যুত হতে পারেন। 🔺[এটাও কদাচিৎ হয়ে থাকে। উপরন্তু, পদচ্যুত ব্যক্তি আল্লাহর দৃষ্টিতে ওলী কখনোই ছিলেন না। কেননা, আল্লাহতায়া'লা তাঁর আউলিয়া বৃন্দেরও বেলায়াত কেড়ে নেন না (সুরা ইউনুস, ৬২ আয়াতে মোযারে’র সিগায় তথা ভবিষ্যৎকালে বলা হয়েছে ‘তাঁরা সন্তাপগ্রস্ত হবেন না’)- অনুবাদক] নবীবৃন্দ (عليه السلام) হলেন পুণ্যাত্মা, তাঁরা জ্বীন কিংবা ফেরেশতা নন – যে জ্বীন ও ফেরেশতা কখনোই নবী হতে পারবেন না; কেননা তাঁরা মানবাত্মা বনতে সক্ষম হবেন না এবং ফলস্বরূপ তাঁরা নবীর মর্যাদাও পাবেন না। নবী আলাইহিমুস সালাম-মণ্ডলী একে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু তাঁর উম্মাত ও প্রেরণের স্থান বৃহত্তম ছিল এবং যেহেতু তাঁর জ্ঞান ও মা’রেফত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রসারিত হয়েছিল এবং যেহেতু তাঁর মো’জেযা অফুরন্ত ও নিয়মিত প্রবাহমান ছিল এবং যেহেতু তাঁর প্রতি খোদা তায়া'লার বিশেষ অনুগ্রহ ও বরকত বর্ষিত হয়েছিল, সেহেতু শেষ যমানার রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام) হতে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন। ‘উলুল আযম’ নামে খ্যাত পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলীও অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام) হতে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন। রসূল (عليه السلام)-মণ্ডলী নবী (عليه السلام)-বৃন্দের চেয়ে উচ্চ মকামের – যে নবীবৃন্দ (عليه السلام) রাসূল নন।
পয়গম্বরবৃন্দের (عليه السلام) সংখ্যা অজ্ঞাত। এটা সর্বজবিদিত যে তাঁদের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজারের অধিক ছিল। তাঁদের মধ্যে ৩১৩ কিংবা ৩১৫ জন রাসূল আলাইহিমুস সালাম। রাসূল আলাইহিমুস সালাম-বৃন্দের মধ্যে ছয় জন হলেন উচ্চ মকামের রাসূল, যাঁদেরকে উলুল আযম বলা হয়। তাঁরা হলেন: হযরত আদম (عليه السلام), হযরত নূহ (عليه السلام), হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام), হযরত মূসা (عليه السلام), হযরত ঈসা (عليه السلام) ও বিশ্বনবী হযরত রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)।
নিম্নোক্ত তেত্রিশ জন পয়গম্বর (عليه السلام) প্রখ্যাত: সর্ব-হযরত আদম (عليه السلام), ইদ্রীস (عليه السلام), শীষ (عليه السلام), নূহ্ (عليه السلام), হুদ (عليه السلام), সালেহ্ (عليه السلام), ইব্রাহীম (عليه السلام), লুত (عليه السلام), ইসমাইল (عليه السلام), ইসহাক (عليه السلام), ইয়াকুব (عليه السلام), ইউসুফ (عليه السلام), আইয়ুব (عليه السلام), শু’য়াইব (عليه السلام), মূসা (عليه السلام), হারুন (عليه السلام), খিযির (عليه السلام)
🔺[এ ব্যাপারে সুন্নী উলামাগণের মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ তাঁকে “ওলী” বলেন। — অনুবাদক],
ইউশা ইবনে নুন (عليه السلام), ইলিয়াস (عليه السلام), আল ইয়াসা (عليه السلام), যুলকিফল (عليه السلام), শামউন (عليه السلام), ইশমোইল (عليه السلام), ইউনুস ইবনে মাতা (عليه السلام), দাউদ (عليه السلام), সুলাইমান (عليه السلام), লোকমান (عليه السلام), যাকারিয়্যা (عليه السلام), ইয়াহইয়া (عليه السلام), উযাইর (عليه السلام), ঈসা ইবনে মরিয়ম (عليه السلام), যুলকারনাইন (عليه السلام) এবং হযরত রাসূলে কারীম (ﷺ)।
কুরআন মজীদে কেবলমাত্র আটাশ জন পয়গম্বরের (عليه السلام) নাম উল্লিখিত আছে। যুলকারনাইন (عليه السلام), লুকমান (عليه السلام), উযাইর (عليه السلام) ও খিযির (عليه السلام) নবী কিনা তা নিশ্চিত নয়। হযরত যুলকিফল (عليه السلام)-কে হারকিলও বলা হয়, যাঁকে সর্ব-হযরত ইলিয়াস (عليه السلام), ইদ্রিস (عليه السلام) কিংবা যাকারিয়্যা (عليه السلام)-ও ধারণা করা হয়ে থাকে।
হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) হলেন খলিলউল্লাহ, কারণ তাঁর অন্তরে আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি মুহব্বত তথা ভালোবাসা নেই। হযরত মূসা (عليه السلام) হলেন কালিম-উল্লাহ, কেননা وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا – তিনি আল্লাহ্ পাকের সাথে কথা বলেছিলেন।
🔺[৭] আল কুরআন : আন নিসা, ৪:১৬৪।
হযরত ঈসা (عليه السلام) হলেন কালেমাতুল্লাহ্, কারণ পিতা ছাড়াই তিনি শুধুমাত্র কালেমাত আল ইলাহিয়্যা (খোদায়ী বাক্য) “হও” (কুন্) দ্বারা-ই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। উপরন্তু, তিনি আল্লাহতায়া'লার বাণী প্রচার করেছিলেন, ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন এবং ঐশীবাণী মানুষের কানে পৌঁছেও দিয়েছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) যিনি সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বশীল হওয়ার কারণ ছিলেন এবং যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মকামের অধিকারী, মহাসম্মানিত ও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি হলেন হাবীবউল্লাহ (আল্লাহতায়া'লার বন্ধু)। তিনি-ই যে হাবীবউল্লাহ ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং মাহাত্ম্যের অধিকারী, তা প্রতীয়মানকারী বহু প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান। এ কারণেই “পরাভূত” কিংবা “পরাজিত হয়েছিলেন” বাক্যগুলো তাঁর শানে ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
❏ পুনরুত্থানের সময় তিনি-ই সর্বাগ্রে তাঁর রওযা শরীফ হতে পুনরুত্থিত হবেন। তিনি-ই প্রথমে বিচারের স্থানে যাবেন। আবার,
وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ–
তিনি-ই সর্বাগ্রে বেহেশতে প্রবেশ করবেন।
🔺[৮]
(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ৩:১৪৪ হাদীস নং ১২৪৯১।
(খ) দারেমী : আস সুনান, ১:১৯৮ হাদীস নং ৫৩।
(গ) বায়হাকী : শুয়াবুল ইমান, ৩:৭৪ হাদীস নং ১৪০৯।
যদিও তাঁর চরিত্রের সুন্দর গুণগুলো গোনে শেষ করা যাবে না এবং তা মানব শক্তি-সামর্থ্য দ্বারা সম্ভবও নয়, তবু আমরা সেগুলোর কয়েকটি এখানে লিখে আমাদের পুস্তককে অলঙ্কৃত করবো:
_____________
কিতাবঃ ঈমান ও ইসলাম
মূল: মওলানা খালেদ আল-বাগদাদী (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন